প্রাচীন
বাংলা ছিল পদ্য নির্ভর। কবিতার ছন্দে সাহিত্য রচনা ছিল সে যুগের রীতি। এই
রীতিপরিবর্তন করে বাংলা সাহিত্যে যিনি গদ্যের প্রবরতন করলেন তিনি উনবিংশ শতকের
রেনাসাসের অন্যতম যুগপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়-তিনি
সমাজ সংস্কারক হিসেবেও ছিলেন সেকালের অগ্রগণ্য। মাইকেল মধুসুদন দত্ত ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলেছেন- তার প্রজ্ঞা ছিল প্রাচীন ভারতীয় ঋষির মতো, সত্যিই
ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন বিরল প্রতিভা ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী।
আকাশে অনেক নক্ষত্র থাকে, তবুও ভোরের আকাশে শুকতারার
দীপ্তি ভোলা যায় না। বাংলার জ্যোর্তিময় পুরুষ বিদ্যাসাগর ছিলেন স্নিগ্ধ উজ্জ্বল এই
নক্ষত্রটির মতো। বিংশ শতকের রাত্রি অবসানগ্রায়। একবিংশ শতকের ঊষালগ্নেও সেই
দূরের শুকতারার আলো আজো আমাদের সরবাঙ্গকে উজ্জ্বল করে তোলে। এ যুগে বসেও অবাক
বিস্ময়ে তাই ভাবেতে হয় কি অসাধরণ এক মানুষ ছিলেন বিদ্যাসাগর।
পৌরুষের এই দীপ্তমহিমা তিনি পেয়েছিলেন তার সত্যবাদী
পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। আর হৃদয়ের এই মমত্ব তার মা ভগবতীদেবীর
দান।
বিদ্যাসাগরের
জন্ম হয়েছিল ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে। পিতা ঠাকুরদাসের
আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিলো না। তিনি কলকাতার এক ধনী ব্যক্তির গৃহে সামান্য
বেতনে চাকুরি করতেন। তাঁদের আর্থিক অবস্থা এতো খারাপ ছিলো যে, রাতে বাতি জ্বালিয়ে
পড়াশোনা করার মতো সঙ্গতিও ছিলো না। তাই বিদ্যাসাগর বাল্যকালে সন্ধ্যার পর পথের
পাশে জ্বালানো গ্রাসের বাতির নিচে দাঁড়িয়ে পড়াশোনা করতেন। তিনি গভীর রাত পর্য্ন্ত
এভাবেই পথের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন পড়া তৈরি করতেন।
পথের
টহল-পুলিশরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতো এই অসাধারণ বালকটির কান্ড দেখে।ছেলেবেলায়
অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তিনি কতোখানি বেধাবী ছিলেন তার একটি
গল্পও আছে। তিনি অত্যান্ত অপ্লবয়সে একবার পায়ে হেঁটে বাবার সাথে কলকাতা গিয়েছিলেন।
পথে পথে মাইলষ্টোনের সংখ্যার হিসেব গুনতে গুনতেই ইংরেজি গণনা শিখে ফেলেছিলেন।
কলকাতা এসে তাঁর শিক্ষা আরম্ভ হয় সংস্কৃত
কলেজে। তাঁর অসাধারণ প্রতিভা এবং শিক্ষার প্রতি অপূ্রব অনুরাগ দেখে শিক্ষকরা
পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
সংস্কৃত কলেজে তিনি মোট তেরো বছর পড়াশোনা
করেন এবং বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। এরপর তিনি যখন সংস্কৃত কলেজ ত্যাগ করেন তখন
তার বয়স ছিলো মাত্র একুশ বছর। এই অসাধরণ মেধা আর অধ্যবসায়ের গুনে তিনি মাত্র ২১
বছর বয়সেই সংস্কৃত সাহিত্য, ব্যাকরণ, ন্যায় বেদান্ত, স্মৃতি অলঙ্কার ইত্যাদি বিষয়ে
অগাধ পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। সংস্কৃত কলেজের পড়াশোনা শেষ করে তিনি ফোর্ট
উইলিয়াম কলেজে পন্ডিতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বিশেষ বিদ্যালয় পরিদর্শকের
দায়িত্বও পালন করতেন একই সাথে।
চাকরি গ্রহণ করার পর গোটা সংসারের দায়িত্ব
এবার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন ইশ্বরচন্দ্র। পিতা চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পর
তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন গ্রামের বাড়িতে। আর তাঁকে খাটতে হবে না।এরপর তিনি নিজের ছোটো
ভাইকেও কলকাতায় নিজের কাছে এনে পড়াশোনা করাতে লাগলেন। শুধু নিজের আত্মীয় নয়, এ সময়
অনেক অনাথ ছাত্রও তাঁর বাসায় থেকে লেখাপড়া করতো। এদিকে কর্মক্ষেত্রে তাঁর ক্রমে
উন্নতি হতে থাকে। আপন বুদ্ধিমত্তা ও পান্ডিত্যের পরিচয় প্রদান করে সংস্কৃত কলেজের
সহকারী সম্পাদক, সংস্কৃতের অধ্যাপক এবং পরে অধ্যক্ষের পদে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু
বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর বিস্ময়কর আত্মমযার্দা বোধ। কোনো
অবস্থাতেই তিনি তাঁর আত্মমযার্দাকে ক্ষুন্ন হতে দেন নি। একবার সংস্কৃত কলেজের
সম্পাদক রমেশ দত্তের সাথে তাঁর কোনো কারণে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। এই মতবিরোধের
কারণেই তিনি মাসিক পাঁচশো টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দিলেন। হঠাৎ এ ধরনের সিদ্ধান্তের
জন্য তাঁকে ভীষণ অর্থকষ্টে পড়তে হয়েছিলো। কিন্তু তবু তিনি তা গ্রাহ্য করেন নি।তাঁর
কাছ অর্থের চেয়ে আত্মমরযাদাবোধটাই বড় ছিলো। কমর্জীবনে প্রবেশের সাথে সাথেই শুরু
হয় তাঁর সাহিত্যকর্মও। তিনি সাহিত্যে অদ্ভুত সৃজনীপ্রতিভার পরিচয় দিতে থাকেন।
চাকরি ছাড়ার পর তিনি একান্তভাবেই সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করেন। কিন্তু তিনি শুধু
অর্থ উপার্জনের জন্য লেখেননি। অধ্যাপক পদে থাকার সময়েই তিনি বাংলায় উন্নতমানের
পাঠ্যপুস্তকের অভাব অনুভব করেছিলেন। এই অভাব পূরণ করার জন্যই গদ্যসাহিত্য রচনা
শুরু করেন। তিনি স্বীয় প্রতিভাবলে বাংলাগদ্যের আড়ষ্টতা দূর করে তাতে একটি
লালিত্যপূর্ণ সাবলীলতা আনতে সক্ষম হন। এ সময়ে তিনি বহু বাংলা গদ্যগ্রন্থ রচনা
করেন, তার হাতে পড়েই বাংলা গদ্যরীতি তার
আপন পথ খুজে পায়। এজন্যই তাঁকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়।
শকুন্তলা, আখ্যানমঞ্জুরী, বোধোদয়, কথামালা,
বেতাল পঞ্চবিংশতি, সীতার বনবাস প্রভৃতি পুস্তক তার অমরকীর্তি। এছাড়া তিনি অনেক
পাঠ্য পুস্তকও রচনা করেছেন। শিশুদের শিক্ষার সুবিধার জন্য তিনি রচনা করেন ‘বর্ণ’
পরিচয়। সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার পথ সুগম করার জন্য রচনা করেন ব্যাকরণের উপক্রমণিকা।
তার আগে তৎকালীন বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ছিলো না।
তাঁর আগে রাজা রামমোহন রায়, ফোর্ট উইলিয়াম
কলেজের কেরি এবং শ্রীরামপুরের মিশনারিগণ যেসব বাংলা গদ্য রচনা করেছিলেন তার ভেতর
কোন সৌন্দরয ছিলো না। বিদ্যাসাগরই সরব প্রথম বাংলা গদ্যসাহিত্যকে নবীন আকার এবং
গাম্ভীর্য প্রদান করেন।শুধু সাহিত্যকর্ম নয় শিক্ষাবিস্তারেও তার ছিলো অশেষ অবদান।
সংস্কৃতশিক্ষার সংস্কার, বাংলাশিক্ষার ভিত্তিস্থাপন এবং স্ত্রীশিক্ষার পত্তন ও
প্রসার তার জীবনের অক্ষয় কীর্তি। তিনি বহু কলেজ ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর
মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মেট্রোপরিটন ইনস্টিটিউশন। বতর্মানে এটি বিদ্যাসাগর কলেজ
নামে খ্যাত।
এদেশে স্ত্রীশিক্ষার বিস্তারে তাঁর অবদান
অবিস্মরণীয়। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে দেশীয় কয়েকজন ধনী ও শিক্ষিত লোকের সহায়তায় এবং
বেথুন সাহেবের উদ্যোগে কলকাতায় ঘটে স্ত্রীশিক্ষাবিস্তারের প্রথম সূত্রপাত।
ছোট লাট হ্যানিডে সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি
মেদিনীপুর, বর্ধমান, গুগলী এবং নদীয়া জেলার নানা স্থানে অনেকগুলো বালিকা বিদ্যালয়
স্থাপন করেন।
বিদ্যাসাগর তার মাকে শ্রদ্ধা করতেন দেবীর
মতো। তিনি মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতেন অকাতরে। গ্রামের দাতব্য-চিকিৎসালয় ও বিদ্যালয়গুলোও
মায়ের ইচ্ছা অনুসারেই তিনি করেছিলেন। একবার মায়ে ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে তিনি বর্ষার
দিনে গভীর রাতে দামোদর নদ সাতরিয়ে পার হয়ে বাড়িতে পৌঁচেছিলেন।
পরের দুঃখ দেখলে তার হৃদয় গলে যেতো। আত্মীয়স্বজন কর্তৃক পরিত্যক্ত
সুদূরপ্রবাসী কবি মাইকেল মধুসুদন দত্তকে তিনি প্রচুর অর্থ সাথায্য করেছিলেন।
মাইকেল মধুসুদন ইউরোপে গিয়ে যখন স্ত্রী পুত্র পরিবার নিয়ে পথে বসেছিলেন তখন
বিদ্যাসাগরই টাকা পাঠিয়ে তাকে দেশে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন।
কবি
নবীনচন্দ্র সেনও যৌবনে বিদ্যাসাগরের অর্থেই লেখাপড়া করেছিলেন।
কিন্তু
তিনি নিজে থাকতেন অত্যন্ত সাদাসিধে পোশাকে, গায়ে মোটা চাদর এবং চটিজুতাই ছিল তার
একমাত্র পরিচ্ছদ।
বিদ্যাসাগরের
জীবনের আরোকটি বড় কীর্তি ছিলো সমাজ-সংস্কার। আমাদের দেশের সামাজিক কৃপ্রাথার
উচ্ছেদ কারার জন্য বিদ্যাসাগর আপ্রান চেষ্টা করেছিলেন। বাল্যবিধবাদের দুঃখ এবং হীন
অবস্থা দেখে তার কোমল হৃদয় বিগলিত হয়েছিলো। তিনি এদের দুর্গতি দূর করার জন্য
হয়েছিলেন বদ্ধপরিকর।
শাস্ত্র থেকেই প্রমান উদ্ধার করে কর্তৃপক্ষের
সাহায্য প্রার্থনা করে বিধবা বিবাহের আন প্রচলন করেন। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুলাই
ভারত সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় ‘বিধবা বিবাহ’ আইন পাস হয়।
বিদ্যাসাগর ছিলেন পিতা মাতার একান্ত বাধ্য
সন্তান। বিন্তু তা সত্ত্বেও বিধবা বিবাহের ব্যাপারে মায়ের সঙ্গে তার কিছুটা
মতবিরোধ দেখা দিয়েছিলো। তিনি মায়ের চেয়েও বড় করে দেখেছিলেন বাংলাদেশের লাখো বিধবা
মায়ের দুঃখকে।
তিনি নিজের ছেলের সাথে এক বিধবা কন্যার বিয়ে
দিয়ে এই আইন প্রচলেনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। মায়ের সাথে এখানেই বিদ্যাসাগরের
মতবিরোধ দেখা দিয়েছিলো। কারণ তাঁর মা এটা চান নি।
এই সমাজ বিপ্লবকে সাথর্ক করে তোলার জন্য
বিদ্যাসাগর ছিলেন পুরোধা পুরুষ। তিনি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে এদেশের হিন্দুসমাজের চেহারা হয়তো আরো বদলে যেতো।
১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে ৭১ বছর বয়সে বিদ্যাসাগর পরলোকগমন করেন।
0 comments :
Post a Comment