(১৭
ডিসেম্বর, ১৯০০ – ১৫ মার্চ ১৯৮৫), স্ব-শিক্ষিত, স্বধর্মত্যাগী দার্শনিক, মানবতাবাদী,
চিন্তাবিদ এবং লেখক। তিনি ১৭ই ডিসেম্বর ১৯০০ (বাংলা সালঃ ১৩০৭)বরিশাল শহর থেকে ১১ কিলোমিটার
দূরে চরবাড়িয়া ইউনিয়নের অন্তর্গতলামছড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম
ছিলো “আরজ আলী”। আঞ্চলিক ভূস্বামী হওয়ার সুবাধে তিনি “মাতুব্বর” নাম ধারণ করেন। তিনি
গরীব কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। গ্রামের মক্তবে কিছুকাল পড়াশোনা করেন, যেখানে
শুধুই কোরানও অন্যান্য ইসলামিক ইতিহাসের উপর শিক্ষা দেয়া হত। তিনি নিজ চেষ্টা ও সাধনায়
বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম ও দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করেন। ধর্ম, জগত
ও জীবন সম্পর্কে নানামুখী জিজ্ঞাসা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে যা থেকে তাঁর প্রজ্ঞা, মুক্তচিন্তা
ও মুক্তবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়।
জীবন
দর্শন ও সৃষ্টি
মাতুব্বর
ছিলেন সাম্যবাদী ঢঙের, অনেক অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখি
করেন। তাঁর লেখার জন্য তাঁকে ধর্মীয় ভাবমূর্তির প্রতিমাধ্বংসকারী হিসেবে বিবেচিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, তিনি ইসলামের বংশগতির ধারা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেন এবং স্বকীয় মত-বৈশিষ্ট্য
একমতে আনতে ব্যর্থ হন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঘাটতি সত্ত্বেও তিনি কতিপয় বই সাহসিকতার
সহিত লেখেন। বিশ্ব ও জীবন সম্পর্কে তাঁর দার্শনিক লেখা বিতর্কিত হয়ে পড়ে। মাতুব্বর
বরিশালের অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির, অধ্যাপক মুহাম্মদ সামসুল হক সহ অন্য অনেক সংখ্যক
সাম্যবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিলো। তাঁর বইগুলো
সর্বদাই সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধের হুমকিতে থাকত, কারণ তাঁর লেখনী রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু
লোকদের মতের বিরুদ্ধাচারিত নির্দিষ্ট দাবিকৃত ধর্মীয় মত বা ভাবাদর্শ ধারণ করত। তার
উত্থাপিত সত্য সন্ধানী প্রশ্নসমূহের কারনে তার নামে মামলা করা হয় এবং পুলিশ হাজতে
নেয়া হয়। মামলার জবাবদিহিতার উদ্দেশ্যে তিনি তার প্রশ্নসমূহের কিছু ব্যাখ্যা রচনা
করেন এবং পরবর্তিতে মামলায় নির্দোষ প্রমানিত হন। এই ব্যাখ্যাসমূহই হল তার 'সত্যের
সন্ধান গ্রন্থের উৎস। পরবর্তিতেও লেখনীর কারণে তিনি যতবার দাবিকৃত ধর্মীয় প্রত্যয়
ব্যক্ত করেন ততবার তাঁকে হুমকি ও হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়।
প্রথম
জীবন
বরিশাল
শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে লামছড়ি নামক গ্রামে বাংলা ১৩০৭ সনের ৩রা পৌষ এক দরিদ্র
কৃষক পরিবারে আরজ আলী মাতুব্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম এন্তাজ আলী মাতুব্বর।
বার বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবাকে হারান। এর পরে দুই একরের (৮১০০ মিটার) বসতবাড়িটি নিলামে
উঠে। জমিজমাহীন বালক আরজ আলী স্থানীয় সুদখোরদের কাছে তখন তাঁদের পরিবারটি দেনার দায়ে
পূর্বপুরুষের ভিটামাটি হারিয়ে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়ে যায়। অন্যের দয়া দাক্ষিণ্যে
বহু কষ্টে খেত খামারে কাজ করার কারণে আর দরিদ্র আরজ আলী আর স্কুলে পড়ার সুযোগ পান
নি।
আরজ
আলী নিজ গ্রামের মুন্সি আবদুল করিমের মসজিদ দ্বারা পরিচালিত মক্তবে সীতানাথ বসাকের
কাছে 'আদর্শলিপি' পড়তেন। দরিদ্রতার কারণে নিয়মানুবর্তিতার অভাবে তাঁকে মক্তব ছাড়তে
হয়। এরপর তিনি কৃষিকাজে নিয়োজিত হন। পরে এক সহৃদয় ব্যক্তির সহায়তায় তিনি প্রাথমিক
শিক্ষা শেষ করেন। সাথে সাথে তিনি নিজের ঐকান্তিক চেষ্টায় লেখাপড়া শিখতে থাকেন। নিজের
জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে তিনি বরিশাল লাইব্রেরীর সমস্ত বাংলা বই একজন মনোযোগী ছাত্রের
ন্যায় পড়েন। দর্শন ছিলো তাঁর প্রিয় বিষয়। কিন্তু পাঠাগারে পর্যাপ্ত বই ছিলো না।
পরে বিএম মহাবিদ্যালয়ের দর্শনের এক শিক্ষক – কাজী গোলাম কাদির তাঁর জ্ঞানগর্ভ বিচার
দেখে মোহিত হন এবং তিনি মহাবিদ্যালয়ের পাঠাগার থেকে বই ধার দেয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
এভাবেই তাঁর মানসিক আকৃতি গঠিত হয়।
শৈশবে
তার মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের ছবি তোলার দায়ে গ্রামের মানুষ তার মায়ের জানাজা পরতে
রাজি হয় নি। শেষে বাড়ির কয়েকজন লোক মিলে তার মায়ের সৎকার করেন। এই ঘটনা আরজ আলীর
ধর্মীয় মৌলবাদ ও কুসংস্কার বিরোধিতার এবং সত্যানুসন্ধিৎসু হয়ে উঠার পেছনে কাজ করেছিল।
বসবাস
আর্থিক
সঙ্কটের কারণে, মাতুব্বর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কোর্স বা ডিগ্রী লাভ করতে পারেন নি। কৃষিকাজের
ফাঁকে ফাঁকে তিনি জমি জরিপ বা আমিনের কাজ শিখে নেন। এরপর জমি জরিপের কাজকেই পেশা হিসেবে
গ্রহণ করেন। কৃষি ক্ষেতের জন্য এভাবে কিছু পুঁজি জমা করেন। নিজের শ্রম, মেধা, বুদ্ধিকে
কাজে লাগিয়ে তিনি আর্থিক অবস্থার উন্নতি করেন এবং জমিদার ও মহাজনদের কাছে বন্ধককৃত
জমিজমা উদ্ধার করেন।
পারিবারিক
জীবন
আরজ
আলী মাতুব্বর ২৯ অগ্রহায়ণ ১৩২৯ সালে লালমন্নেছাকে বিয়ে করেন। বিয়ের সময় কনের বয়স
ছিল ১৩ বছর। তাঁদের তিন মেয়ে :এশারন নেছা, ছলেমান নেছা এবং ফয়জন্নেছা; একছেলে: আব্দুল
মালেক। পরে তিনি পাশের গ্রামের আব্দুল করিম মৃধার মেয়ে সুফিয়াকে বিয়ে করেন। এই সংসারে
তাঁদের চারটি মেয়ে : হাজেরা খাতুন, মনোয়ারা খাতুন, নূরজাহান বেগম ও বায়াম্মা বেগম;
দুই ছেলে : আবদুল খালেক ও আবদুল বারেক। তিনি দশ সন্তানের জনক ছিলেন।
মৃত্যু
১৫ই
মার্চ ১৯৮৫ সাল (বাংলা সনের ১লা চৈত্র ১৩৯২) তিনি ৮৬ বছর বয়সে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ
হাসপাতালে পরলোকগমন করেন।তিনি মরণোত্তর চক্ষুদান করেন।মেডিকেলের ছাত্রদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে
ব্যবহারের জন্য শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ-এর এনাটমি বিভাগে মরণোত্তর দেহদান করেন।
লেখালেখি
ও রচনাবলী
মাতুব্বরকে
তাঁর বইগুলো প্রকাশে অনেক বাধা পেরোতে হয়েছিলো। এমনকি তিনি তাঁর প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদও
আঁকেন, যেটি ১৯৫২ সালে লেখেন এবং ১৯৭৩ সালে “সত্যের সন্ধানে” তা ছাপানো হয়। এই বইটি
তাঁকে তাঁর এলাকায় “শিক্ষিত ব্যক্তি” হিসেবে সুনাম এনে দিয়েছিলো। মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেনঃ
“আমি অনেক কিছুই ভাবছি, আমার মন প্রশ্নে ভরপুর কিন্তু এলোমেলোভাবে। আমি তখন প্রশ্নের
সংক্ষেপণ লিখতে থাকি, বই লেখার জন্য নয় শুধুমাত্র পরবর্তীতে মনে করার জন্য। অসীম সমুদ্রের
মতন সেই প্রশ্নগুলো আমার মনে গেঁথে আছে এবং আমি ধীরে ধীরে ধর্মীয় গন্ডি হতে বের হতে
থাকি।”
তিনি
এই বইটিতে দার্শনিক প্রশ্নগুলোর ৬টি শ্রেণীতে তার প্রশ্ন ও তাদের যৌক্তিক ব্যাখ্যা
তুলে ধরেন। সেগুলো হলোঃ
প্রথম
প্রস্তাবঃ আত্মা বিষয়ক। এই অংশে ৮টি প্রশ্ন।
দ্বিতীয়
প্রস্তাবঃ ঈশ্বর বিষয়ক। এই অংশে ১১টি প্রশ্ন।
তৃতীয়
প্রস্তাবঃ পরকাল বিষয়ক। এই অংশে ৭টি প্রশ্ন।
চতুর্থ
প্রস্তাবঃ ধর্ম বিষয়ক। এই অংশে ২২টি প্রশ্ন।
পঞ্চম
প্রস্তাবঃ প্রকৃতি বিষয়ক। এই অংশে ১১ টি প্রশ্ন।
ষষ্ঠ
প্রস্তাবঃ বিবিধ। এই অংশে ৯টি প্রশ্ন।
(সংগ্রহ:
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে)
0 comments :
Post a Comment