Tuesday, January 6, 2015

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর











(৭ই মে১৮৬১ -৭ই আগস্ট১৯৪১ (২৫ বৈশাখ১২৬৮ - ২২ শ্রাবণ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবিঔপন্যাসিকসংগীতস্রষ্টানাট্যকারচিত্রকরছোটগল্পকারপ্রাবন্ধিকঅভিনেতাকণ্ঠশিল্পী  দার্শনিক।তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকেগুরুদেবকবিগুরু  বিশ্বকবিঅভিধায় ভূষিত করা হয়।রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ৩৮টি নাটক১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ  অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প   ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ  গীতবিতানসংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত  গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডেরবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে।রবীন্দ্রনাথের যাবতীয়পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র  চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত।এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন।রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালেগীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার এক ধনাঢ্য  সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয়-শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননিগৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।[১৯আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন।১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা- তাঁর "অভিলাষকবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা।১৮৭৮ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান।১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন।১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন।[২৩১৯০২ সালে তাঁর পত্নীবিয়োগ হয়।[২৩১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।[২৩১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন।[২৩কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন।[২৪১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।[২৫১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়।[২৬দীর্ঘজীবনে তিনি বহুবারবিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন।[২৫১৯৪১ সালে দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনেই তাঁর মৃত্যু হয়।[২৭]
রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতাগীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তাঅধ্যাত্মচেতনাঐতিহ্যপ্রীতিপ্রকৃতিপ্রেমমানবপ্রেমস্বদেশপ্রেমবিশ্বপ্রেমরোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনাভাবভাষাছন্দ  আঙ্গিকের বৈচিত্র্যবাস্তবচেতনা  প্রগতিচেতনা।[২৮রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক।[২৯ভারতের ধ্রুপদি  লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা  শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।[৩০কথাসাহিত্য  প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজরাজনীতি  রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন।[৩১সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন  গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন।[৩২এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদঅস্পৃশ্যতাধর্মীয় গোঁড়ামি  ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।[৩৩রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছেরবীন্দ্রনাথ দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পূজার কথা বলেছিলেন।[৩৪সংগীত  নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন।[৩৫রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি।[৩৬তাঁর রচিত আমার সোনার বাংলা  জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে গানদুটি যথাক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ  ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত।[৩৭]

জীবন
প্রথম জীবন (১৮৬১১৯০১)
মূল নিবন্ধরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন (১৮৬১১৯০১)
শৈশব  কৈশোর (১৮৬১ - ১৮৭৮)


কিশোর রবীন্দ্রনাথ১৮৭৭জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্কেচ অবলম্বনে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকর্তৃক অঙ্কিত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকোঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮১৭১৯০৫)[৩৮এবং মাতা ছিলেন সারদাসুন্দরী দেবী (১৮২৬১৮৭৫)[৩৯]রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান।খ[›][৪০জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারছিল ব্রাহ্ম আদিধর্ম মতবাদের প্রবক্তা।[৪১][৪২]রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষেরা খুলনা জেলার রূপসা উপজেলা পিঠাভোগে বাস করতেন।[৪৩]১৮৭৫ সালে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের মাতৃবিয়োগ ঘটে।[২২পিতা দেবেন্দ্রনাথ দেশভ্রমণের নেশায় বছরের অধিকাংশ সময় কলকাতার বাইরে অতিবাহিত করতেন। তাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছিল ভৃত্যদের অনুশাসনে।[৪৪][৪৫শৈশবে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিনর্ম্যাল স্কুলবেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন করে পড়াশোনা করেছিলেন।[৪৬কিন্তু বিদ্যালয়-শিক্ষায় অনাগ্রহী হওয়ায় বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।[৪৭ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অথবা বোলপুর  পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করতেন রবীন্দ্রনাথ।[৪৮][৪৯]
১৮৭৩ সালে এগারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।[২১এরপর তিনি কয়েক মাসের জন্য পিতার সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন।[২১প্রথমে তাঁরা আসেন শান্তিনিকেতনে।[৫০]এরপর পাঞ্জাবের অমৃতসরে কিছুকাল কাটিয়ে শিখদের উপাসনা পদ্ধতি পরিদর্শন করেন।[৫০শেষে পুত্রকে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ যান পাঞ্জাবেরই (অধুনা ভারতের হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে অবস্থিতডালহৌসিশৈলশহরের নিকট বক্রোটায়।[৫০এখানকার বক্রোটা বাংলোয় বসে রবীন্দ্রনাথ পিতার কাছ থেকেসংস্কৃত ব্যাকরণইংরেজিজ্যোতির্বিজ্ঞানসাধারণ বিজ্ঞান  ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতে শুরু করেন।[৫০দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জীবনীকালিদাস রচিত ধ্রুপদি সংস্কৃত কাব্য  নাটক এবং উপনিষদ্ পাঠেও উৎসাহিত করতেন।[৫১][৫২১৮৭৭ সালে ভারতী পত্রিকায় তরুণ রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। এগুলি হল মাইকেল মধুসূদনের "মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা", ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী এবং "ভিখারিণী "করুণানামে দুটি গল্প। এর মধ্যে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কবিতাগুলি রাধা-কৃষ্ণ বিষয়কপদাবলির অনুকরণে "ভানুসিংহভণিতায় রচিত।[৫৩রবীন্দ্রনাথের "ভিখারিণীগল্পটি (১৮৭৭বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটগল্প।[৫৪][৫৫১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ তথা প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ কবিকাহিনী।[৫৬এছাড়া এই পর্বে তিনি রচনা করেছিলেন সন্ধ্যাসংগীত(১৮৮২কাব্যগ্রন্থটি। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা "নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গএই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত।[৫৭]
যৌবন (১৮৭৮-১৯০১)


স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ১৮৮৩
১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান রবীন্দ্রনাথ।[৫৮প্রথমে তিনি ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।[৫৮১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু সাহিত্যচর্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি।[৫৮ইংল্যান্ডে থাকাকালীন শেকসপিয়রও অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। এই সময় তিনি বিশেষ মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন রিলিজিও মেদিচি,কোরিওলেনাস এবং অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা।[৫৯এই সময় তাঁর ইংল্যান্ডবাসের অভিজ্ঞতার কথা ভারতীপত্রিকায় পত্রাকারে পাঠাতেন রবীন্দ্রনাথ। উক্ত পত্রিকায় এই লেখাগুলি জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরসমালোচনাসহ[৫৮প্রকাশিত হত য়ুরোপযাত্রী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্রধারা নামে।[২২১৮৮১ সালে সেই পত্রাবলি য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র নামে গ্রন্থাকারে ছাপা হয়। এটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যগ্রন্থ তথা প্রথম চলিত ভাষায় লেখা গ্রন্থ।[৫৮]অবশেষে ১৮৮০ সালে প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে কোনো ডিগ্রি না নিয়ে এবং ব্যারিস্টারি পড়া শুরু না করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন।[৫৮]
১৮৮৩ সালের  ডিসেম্বর (২৪ অগ্রহায়ণ১২৯০ বঙ্গাব্দঠাকুরবাড়ির অধস্তন কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ সম্পন্ন হয়।[৬০বিবাহিত জীবনে ভবতারিণীর নামকরণ হয়েছিল মৃণালিনী দেবী (১৮৭৩১৯০২ )[৬০রবীন্দ্রনাথ  মৃণালিনীর সন্তান ছিলেন পাঁচ জনমাধুরীলতা (১৮৮৬১৯১৮), রথীন্দ্রনাথ (১৮৮৮১৯৬১), রেণুকা (১৮৯১১৯০৩), মীরা (১৮৯৪১৯৬৯এবং শমীন্দ্রনাথ (১৮৯৬১৯০৭)[৬০এঁদের মধ্যে অতি অল্প বয়সেই রেণুকা  শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটে।[৬১]


শিলাইদহ কুঠিবাড়িবর্তমান চিত্র
১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে নদিয়া(নদিয়ার উক্ত অংশটি অধুনা বাংলাদেশেরকুষ্টিয়া জেলা), পাবনা  রাজশাহী জেলা এবংউড়িষ্যার জমিদারিগুলির তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ।[৬২কুষ্টিয়ার শিলাইদহেরকুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছিলেন। জমিদার রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে "পদ্মানামে একটি বিলাসবহুল পারিবারিক বজরায় চড়ে প্রজাবর্গের কাছে খাজনা আদায়  আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে যেতেন। গ্রামবাসীরাও তাঁর সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করত।[৬৩]
১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথের অপর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ মানসী প্রকাশিত হয়। কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে তাঁর আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ  গীতিসংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলি হলো প্রভাতসংগীতশৈশবসঙ্গীতরবিচ্ছায়াকড়ি  কোমল ইত্যাদি।[৬৪১৮৯১ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত নিজের সম্পাদিত সাধনা পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু উৎকৃষ্ট রচনা প্রকাশিত হয়। তাঁর সাহিত্যজীবনের এই পর্যায়টি তাই "সাধনা পর্যায়নামে পরিচিত।[৪৪]রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ গ্রন্থের প্রথম চুরাশিটি গল্পের অর্ধেকই এই পর্যায়ের রচনা।[৫৪এই ছোটগল্পগুলিতে তিনি বাংলার গ্রামীণ জনজীবনের এক আবেগময়  শ্লেষাত্মক চিত্র এঁকেছিলেন।[৬৫]
মধ্য জীবন (১৯০১১৯৩২)
মূল নিবন্ধরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন (১৯০১১৯৩২)


১৯১২ সালে হ্যাম্পস্টেডে রবীন্দ্রনাথবন্ধু উইলিয়াম রোদেনস্টাইনের শিশুপুত্র জন রোদেনস্টাইন কর্তৃক গৃহীত ফটোগ্রাফ।
১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে শিলাইদহছেড়ে চলে আসেন বীরভূম জেলার বোলপুরশহরের উপকণ্ঠে শান্তিনিকেতনে।[৬৬এখানে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৮ সালে একটি আশ্রম  ১৮৯১ সালে একটি ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[৬৭আশ্রমের আম্রকুঞ্জ উদ্যানে একটি গ্রন্থাগার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চালু করলেন "ব্রহ্মবিদ্যালয়বা "ব্রহ্মচর্যাশ্রনামে একটি পরীক্ষামূলক স্কুল।[৬৮১৯০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী মারা যান।[৬৯এরপর ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কন্যা রেণুকা,[৭০১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর[৭১ ১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়।[৭১]
এসবের মধ্যেই ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথবঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন।[৭২১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান আধুনিক কৃষি  গোপালন বিদ্যা শেখার জন্য।[৭৩১৯০৭ সালে কনিষ্ঠা জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কেও কৃষিবিজ্ঞান শেখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।[৭৪]
এই সময় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ে অর্থসংকট তীব্র হয়ে ওঠে। পাশাপাশি পুত্র  জামাতার বিদেশে পড়াশোনার ব্যয়ভারও রবীন্দ্রনাথকে বহন করতে হয়।[৭৪এমতাবস্থায় রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর গয়না  পুরীর বসতবাড়িটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।[৭৫]
ইতোমধ্যেই অবশ্য বাংলা  বহির্বঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯০১ সালেনৈবেদ্য  ১৯০৬ সালে খেয়া কাব্যগ্রন্থের পর ১৯১০ সালে তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলিপ্রকাশিত হয়।[][৭৬১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি (ইংরেজি অনুবাদ১৯১২কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য সুইডিশ অ্যাকাডেমি রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে।গ[›][৭৭]১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে 'স্যারউপাধি (নাইটহুডদেয়।[৭৮]
১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনের অদূরে সুরুল গ্রামে মার্কিন কৃষি-অর্থনীতিবিদ লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট,রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিনিকেতনের আরও কয়েকজন শিক্ষক  ছাত্রের সহায়তায় রবীন্দ্রনাথ "পল্লীসংগঠন কেন্দ্রনামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।[৭৯এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নতিসাধনম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগ নিবারণসমবায় প্রথায় ধর্মগোলা স্থাপনচিকিৎসার সুব্যবস্থা এবং সাধারণ গ্রামবাসীদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি করা।[৭৯১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ এই সংস্থার নাম পরিবর্তন করে রাখেন "শ্রীনিকেতন"[৮০শ্রীনিকেতন ছিল মহাত্মা গান্ধীর প্রতীক  প্রতিবাদসর্বস্ব স্বরাজ আন্দোলনের একটি বিকল্প ব্যবস্থা। উল্লেখ্যরবীন্দ্রনাথগান্ধীর আন্দোলনের পন্থা-বিরোধী ছিলেন।[৮১পরবর্তীকালে দেশ  বিদেশের একাধিক বিশেষজ্ঞদাতা  অন্যান্য পদাধিকারীরা শ্রীনিকেতনের জন্য আর্থিক  অন্যান্য সাহায্য পাঠিয়েছিলেন।[৮২][৮৩]
১৯৩০-এর দশকের প্রথম ভাগে একাধিক বক্তৃতাগান  কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সমাজের বর্ণাশ্রম প্রথা  অস্পৃশ্যতার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।[৮৪][৮৫]
শেষ জীবন (১৯৩২-১৯৪১)
মূল নিবন্ধরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন (১৯৩২১৯৪১)


১৯৩০ সালে বার্লিনে রবীন্দ্রনাথ
জীবনের শেষ দশকে (১৯৩২-১৯৪১রবীন্দ্রনাথের মোট পঞ্চাশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।[৮৬তাঁর এই সময়কার কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পুনশ্চ (১৯৩২),শেষ সপ্তক (১৯৩৫), শ্যামলী  পত্রপুট(১৯৩৬) – এই গদ্যকবিতা সংকলন তিনটি।[জীবনের এই পর্বে সাহিত্যের নানা শাখায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল হলো তাঁর একাধিক গদ্যগীতিকা  নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা (১৯৩৬চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২কাব্যনাট্যের নৃত্যাভিনয়-উপযোগী রূপ) [৮৭],শ্যামা (১৯৩৯ চণ্ডালিকা (১৯৩৯নৃত্যনাট্যত্রয়ী।[৮৮এছাড়া রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ তিনটি উপন্যাসও (দুই বোন (১৯৩৩),মালঞ্চ (১৯৩৪ চার অধ্যায় (১৯৩৪)) এই পর্বে রচনা করেছিলেন।[তাঁর অধিকাংশ ছবি জীবনের এই পর্বেই আঁকা।[১৩এর সঙ্গে সঙ্গে জীবনের শেষ বছরগুলিতে বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন বিশ্বপরিচয়।[৮৯এই গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের আধুনিকতম সিদ্ধান্তগুলি সরল বাংলা গদ্যে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।[৮৯পদার্থবিদ্যাও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর অর্জিত জ্ঞানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তাঁর কাব্যেও।[৯০সে(১৯৩৭), তিন সঙ্গী (১৯৪০ গল্পসল্প (১৯৪১গল্পসংকলন তিনটিতে তাঁর বিজ্ঞানী চরিত্র-কেন্দ্রিক একাধিক গল্প সংকলিত হয়েছে।[৯১]
জীবনের এই পর্বে ধর্মীয় গোঁড়ামি  কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্রতম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ বিহার প্রদেশে ভূমিকম্পে শতাধিক মানুষের মৃত্যুকে গান্ধীজি "ঈশ্বরের রোষবলে অভিহিত করলেরবীন্দ্রনাথ গান্ধীজির এহেন বক্তব্যকে অবৈজ্ঞানিক বলে চিহ্নিত করেন এবং প্রকাশ্যে তাঁর সমালোচনা করেন।[৯২কলকাতার সাধারণ মানুষের আর্থিক দুরবস্থা  ব্রিটিশ বাংলা প্রদেশের দ্রুত আর্থসামাজিক অবক্ষয় তাঁকে বিশেষভাবে বিচলিত করে তুলেছিল। গদ্যছন্দে রচিত একটি শত-পংক্তির কবিতায় তিনি এই ঘটনা চিত্রায়িতও করেছিলেন।[৯৩][৯৪]
জীবনের শেষ চার বছর ছিল তাঁর ধারাবাহিক শারীরিক অসুস্থতার সময়।[৯৫এই সময়ের মধ্যে দুইবার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল তাঁকে।[৯৫১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল কবির।[৯৫সেবার সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সেরে উঠতে পারেননি।[৯৫এই সময়পর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি ছিল মৃত্যুচেতনাকে কেন্দ্র করে সৃজিত কিছু অবিস্মরণীয় পংক্তিমালা।[৯৫][৯৬মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল ছিলেন।[২৭দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালে জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।[৯৭][৯৮]
বিশ্বভ্রমণ
মূল নিবন্ধরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভ্রমণ


আইনস্টাইনের সঙ্গে১৯৩০
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট বারো বার বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন।[৯৯১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে তিনি পাঁচটি মহাদেশের ত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন।[১০০প্রথম জীবনে দুই বার (১৮৭৮  ১৮৯০ সালেতিনি ইংল্যান্ডেগিয়েছিলেন।[৯৯১৯১২ সালে ব্যক্তিগত চিকিৎসার জন্য তৃতীয়বার ইংল্যান্ডে গিয়েইয়েটস প্রমুখ কয়েকজন ইংরেজ কবি  বুদ্ধিজীবীদের কাছে সদ্যরচিত গীতাঞ্জলিকাব্যের ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে শোনান।[৯৯কবিতাগুলি শুনে তাঁরাও মুগ্ধ হয়েছিলেন।[৯৯ইয়েটস স্বয়ং উক্ত কাব্যের ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকাটি লিখে দিয়েছিলেন।[১০১এই ভ্রমণের সময়েই "দীনবন্ধুচার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে।[১০২১৯১৩ সালে সুইডিশ অ্যাকাডেমি তাঁকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করে।[৯৯১৯১৬-১৭ সালে জাপান  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদ  উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কতকগুলি বক্তৃতা দেন।[১০৩][১০৪][১০৫এই বক্তৃতাগুলি সংকলিত হয় তাঁর ন্যাশনালিজম (১৯১৭গ্রন্থে।[৯৯][১০৬তবে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিরূপ মতামত উক্ত দুই দেশে সেই সফরকালে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।[৯৯১৯২০-২১ সাল নাগাদ আবার ইউরোপ  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান কবি।[৯৯এই সফরের সময় পাশ্চাত্য দেশগুলিতে তিনি সংবর্ধিত হয়েছিলেন।[৯৯১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ যান চীন সফরে।[৯৯এরপর চীন থেকে জাপানে গিয়ে সেখানেও জাতীয়তাবাদবিরোধী বক্তৃতা দেন কবি।[৯৯১৯২৪ সালের শেষের দিকে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে সেদেশে যাওয়ার পথে আর্জেন্টিনায় অসুস্থ হয়ে কবিভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথ্যে তিন মাস কাটান।[১০৭স্বাস্থ্যের কারণে পেরু ভ্রমণ তিনি স্থগিত করে দেন।[১০৮পরে পেরু  মেক্সিকো উভয় দেশের সরকারই বিশ্বভারতীকে ,০০,০০০ মার্কিন ডলার অর্থসাহায্য প্রদান করেছিল।[১০৯১৯২৬ সালে বেনিতো মুসোলিনির আমন্ত্রণে ইতালি সফরে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।[১১০প্রথমে মুসোলিনির আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলেওপরে লোকমুখে তাঁর স্বৈরাচারের কথা জানতে পেরেমুসোলিনির কাজকর্মের সমালোচনা করেন কবি। এর ফলে উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ছেদ পড়ে।[১১১এরপর রবীন্দ্রনাথ গ্রিসতুরস্ক  মিশর ভ্রমণ করে ভারতে ফিরে আসেন।[৯৯]


তেহরানের মজলিশে১৯৩২[১১২]
১৯২৭ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ চার সঙ্গীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরে। এই সময় তিনি ভ্রমণ করেন বালিজাভাকুয়ালালামপুরমালাক্কাপেনাং,সিয়াম  সিঙ্গাপুর।[১১৩১৯৩০ সালে কবি শেষবার ইংল্যান্ডে যান অক্সফোর্ডে হিবার্ট বক্তৃতা দেওয়ার জন্য।[৯৯এরপর তিনি ভ্রমণ করেন ফ্রান্সজার্মানিসুইজারল্যান্ডসোভিয়েত রাশিয়া  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।[১১৪][১১৫][১১৬]১৯৩২ সালে ইরাক  পারস্য ভ্রমণে গিয়েছিলেন কবি।[৯৯এরপর ১৯৩৪ সালে সিংহলে যান রবীন্দ্রনাথ। এটিই ছিল তাঁর সর্বশেষ বিদেশ সফর।[১১৭][১১৮]
রবীন্দ্রনাথ যেসকল বইতে তাঁর বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাগুলি লিপিবদ্ধ করে রাখেন সেগুলি হল:য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র (১৮৮১), য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি (১৮৯১১৮৯৩), জাপান-যাত্রী (১৯১৯),যাত্রী (পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি  জাভা-যাত্রীর পত্র১৯২৯), রাশিয়ার চিঠি (১৯৩১), পারস্যে(১৯৩৬ পথের সঞ্চয় (১৯৩৯)[৯৯ব্যাপক বিশ্বভ্রমণের ফলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমসাময়িকঅরিঁ বের্গসঁআলবার্ট আইনস্টাইনরবার্ট ফ্রস্টটমাস মানজর্জ বার্নার্ড এইচ জি ওয়েলস,রোম্যাঁ রোলাঁ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলেন।[১১৯][১২০জীবনের একেবারে শেষপর্বে পারস্যইরাক  সিংহল ভ্রমণের সময় মানুষের পারস্পরিক ভেদাভেদ  জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর বিতৃষ্ণা আরও তীব্র হয়েছিল মাত্র।[১২১অন্যদিকে বিশ্বপরিক্রমার ফলে ভারতের বাইরে নিজের রচনাকে পরিচিত করে তোলার এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিনিময়ের সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি।[৯৯]
সৃষ্টিকর্ম
মূল নিবন্ধরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্ম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মূলত এক কবি। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি কাব্যরচনা শুরু করেন। তাঁর প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৫২। তবে বাঙালি সমাজে তাঁর জনপ্রিয়তা প্রধানত সংগীতস্রষ্টা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ প্রায় দুই হাজার গান লিখেছিলেন। কবিতা  গান ছাড়াও তিনি ১৩টি উপন্যাস৯৫টি ছোটগল্প৩৬টি প্রবন্ধ  গদ্যগ্রন্থ এবং ৩৮টি নাটক রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র রচনা রবীন্দ্র রচনাবলী নামে ৩২ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তাঁর সামগ্রিক চিঠিপত্র উনিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রবর্তিত নৃত্যশৈলী "রবীন্দ্রনৃত্যনামে পরিচিত।[১২২]
কবিতা


কবির হস্তাক্ষরে কবিতাহাঙ্গেরিতে লিখিত১৯২৬বাংলা  ইংরেজিতে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম জীবনে ছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তীর (১৮৩৫-১৮৯৪অনুসারী কবি।[১২৩তাঁর কবিকাহিনীবনফুলও ভগ্নহৃদয় কাব্য তিনটিতে বিহারীলালের প্রভাব সুস্পষ্ট।[১২৪সন্ধ্যাসংগীত কাব্যগ্রন্থ থেকে রবীন্দ্রনাথ নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে শুরু করেন।[১২৪এই পর্বের সন্ধ্যাসংগীত,প্রভাতসংগীতছবি  গান  কড়ি  কোমলকাব্যগ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু ছিল মানব হৃদয়ের বিষণ্ণতাআনন্দমর্ত্যপ্রীতি  মানবপ্রেম।[১২৪১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসীএবং তার পর প্রকাশিত সোনার তরী (১৮৯৪),চিত্রা (১৮৯৬), চৈতালি (১৮৯৬), কল্পনা(১৯০০ ক্ষণিকা (১৯০০কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের প্রেম  সৌন্দর্য সম্পর্কিত রোম্যান্টিক ভাবনা।[১২৪১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রাধান্য লক্ষিত হয়। এই চিন্তা ধরা পড়েছে নৈবেদ্য (১৯০১),খেয়া (১৯০৬), গীতাঞ্জলি (১৯১০), গীতিমাল্য(১৯১৪ গীতালি (১৯১৪কাব্যগ্রন্থে।[১২৪]১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটলেবলাকা (১৯১৬কাব্যে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার পরিবর্তে আবার মর্ত্যজীবন সম্পর্কে আগ্রহ ফুটে ওঠে।[১২৪পলাতকা (১৯১৮কাব্যে গল্প-কবিতার আকারে তিনি নারীজীবনের সমসাময়িক সমস্যাগুলি তুলে ধরেন।[১২৪পূরবী (১৯২৫ মহুয়া (১৯২৯কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ আবার প্রেমকে উপজীব্য করেন।[১২৪এরপর পুনশ্চ (১৯৩২), শেষ সপ্তক(১৯৩৫), পত্রপুট (১৯৩৬ শ্যামলী (১৯৩৬নামে চারটি গদ্যকাব্য প্রকাশিত হয়।[১২৪]জীবনের শেষ দশকে কবিতার আঙ্গিক  বিষয়বস্তু নিয়ে কয়েকটি নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।[১২৪এই সময়কার রোগশয্যায় (১৯৪০), আরোগ্য (১৯৪১), জন্মদিনে(১৯৪১ শেষ লেখা (১৯৪১মরণোত্তর প্রকাশিতকাব্যে মৃত্যু  মর্ত্যপ্রীতিকে একটি নতুন আঙ্গিকে পরিস্ফুট করেছিলেন তিনি।[১২৪শেষ কবিতা "তোমার সৃষ্টির পথমৃত্যুর আট দিন আগে মৌখিকভাবে রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।[১২৪]
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব পদাবলিউপনিষদ্কবীরের দোঁহাবলিলালনের বাউল গান  রামপ্রসাদ সেনের শাক্ত পদাবলি সাহিত্যের প্রভাব লক্ষিত হয়।[১২৫][১২৬][১২৭তবে প্রাচীন সাহিত্যের দুরূহতার পরিবর্তে তিনি এক সহজ  সরস কাব্যরচনার আঙ্গিক গ্রহণ করেছিলেন। আবার ১৯৩০-এর দশকে কিছু পরীক্ষামূলক লেখালেখির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা  বাস্তবতাবোধের প্রাথমিক আবির্ভাব প্রসঙ্গে নিজ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছিলেন কবি।[১২৮বহির্বিশ্বে তাঁর সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত কাব্যগ্রন্থটি হল গীতাঞ্জলি।  বইটির জন্যই তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন।[১২৯নোবেল ফাউন্ডেশন তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটিকে বর্ণনা করেছিল একটি "গভীরভাবে সংবেদনশীলউজ্জ্বল  সুন্দর কাব্যগ্রন্থরূপে।[১৩০]
ছোটগল্প
চিত্র:The Hero Illustration.jpg
১৯১৩ সালে ম্যাকমিলান প্রকাশিত দ্য ক্রেসেন্ট মুন (শিশু ভোলানাথঅনুবাদগ্রন্থের দ্য হিরো (বীরপুরুষআখ্যানকবিতার নন্দলাল বসুকৃত অলংকরণ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার।[১৩১][১৩২মূলত হিতবাদীসাধনা,ভারতীসবুজ পত্র প্রভৃতি মাসিক পত্রিকাগুলির চাহিদা মেটাতে তিনি তাঁর ছোটগল্পগুলি রচনা করেছিলেন।[১৩৩এই গল্পগুলির উচ্চ সাহিত্যমূল্য-সম্পন্ন।[১৩৩রবীন্দ্রনাথের জীবনের "সাধনাপর্বটি (১৮৯১৯৫ছিল সর্বাপেক্ষা সৃষ্টিশীল পর্যায়। তাঁরগল্পগুচ্ছ গল্পসংকলনের প্রথম তিন খণ্ডের চুরাশিটি গল্পের অর্ধেকই রচিত হয় এই সময়কালের মধ্যে।[৫৪গল্পগুচ্ছ সংকলনের অন্য গল্পগুলির অনেকগুলিই রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রজীবনের সবুজ পত্র পর্বে (১৯১৪১৭প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকার নামানুসারে) [৫৪তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হল "কঙ্কাল", "নিশীথে", "মণিহারা", "ক্ষুধিত পাষাণ", "স্ত্রীর পত্র", "নষ্টনীড়", "কাবুলিওয়ালা", "হৈমন্তী", "দেনাপাওনা", "মুসলমানীর গল্পইত্যাদি।[১৩৩শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথলিপিকাসে  তিনসঙ্গী গল্পগ্রন্থে নতুন আঙ্গিকে গল্পরচনা করেছিলেন।[১৩৪]
রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি বা আধুনিক ধ্যানধারণা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করতেন। কখনও তিনি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বৌদ্ধিক বিশ্লেষণকেই গল্পে বেশি প্রাধান্য দিতেন।[১৩৫]
রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্রনাটক  টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। তাঁর গল্পের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রায়ণ হল সত্যজিৎ রায় পরিচালিত তিন কন্যা("মনিহারা", "পোস্টমাস্টার "সমাপ্তিঅবলম্বনে)[১৩৬ চারুলতা ("নষ্টনীড়অবলম্বনে)[১৩৭], তপন সিংহ পরিচালিত অতিথিকাবুলিওয়ালা  ক্ষুধিত পাষাণ[১৩৮], পূর্ণেন্দু পত্রীপরিচালিত স্ত্রীর পত্র[১৩৯ইত্যাদি।
উপন্যাস


কাঠের সিলে খোদিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামের আদ্যক্ষরদ্বয় ("-") প্রাচীন হাইদাখোদাই লিপির সঙ্গে এর শৈলীগত মিল লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই তাঁর পাণ্ডুলিপিগুলিতে এই ধরণের নকশা অঙ্কন করতেন।[১৪০]
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট তেরোটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন।[১৩৩এগুলি হলবৌ-ঠাকুরাণীর হাট (১৮৮৩), রাজর্ষি (১৮৮৭),চোখের বালি (১৯০৩), নৌকাডুবি (১৯০৬),প্রজাপতির নির্বন্ধ (১৯০৮), গোরা (১৯১০),ঘরে বাইরে (১৯১৬), চতুরঙ্গ (১৯১৬),যোগাযোগ (১৯২৯), শেষের কবিতা (১৯২৯),দুই বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪ চার অধ্যায় (১৯৩৪)[১৩৩বৌ-ঠাকুরাণীর হাট ওরাজর্ষি ঐতিহাসিক উপন্যাস। এদুটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস রচনার প্রচেষ্টা।[১৩৩এরপর থেকে ছোটগল্পের মতো তাঁর উপন্যাসগুলিও মাসিকপত্রের চাহিদা অনুযায়ী নবপর্যায় বঙ্গদর্শনপ্রবাসীসবুজ পত্র,বিচিত্রা প্রভৃতি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।[১৩৩]
চোখের বালি উপন্যাসে দেখানো হয়েছে সমসাময়িককালে বিধবাদের জীবনের নানা সমস্যা।[১৩৩নৌকাডুবি উপন্যাসটি আবার লেখা হয়েছে জটিল পারিবারিক সমস্যাগুলিকে কেন্দ্র করে।[১৩৩গোরা রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।[১৩৩এই উপন্যাসে দেখানো হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের হিন্দু  ব্রাহ্মসমাজের সংঘাত  ভারতের তদানীন্তন সামাজিক  রাজনৈতিক সমস্যাগুলি।[১৩৩ঘরে বাইরে উপন্যাসের বিষয়বস্তু ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নারী  পুরুষের সম্পর্কের জটিলতা।[১৪১][১৪২][১৪৩স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের জটিলতা আরও সূক্ষ্মভাবে উঠে এসেছে তাঁর পরবর্তী যোগাযোগ উপন্যাসেও।[১৩৩চতুরঙ্গউপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের “ছোটগল্পধর্মী উপন্যাস[১৩৩স্ত্রীর অসুস্থতার সুযোগে স্বামীর অন্য স্ত্রীলোকের প্রতি আসক্তি – এই বিষয়টিকে উপজীব্য করে রবীন্দ্রনাথ দুই বোন  মালঞ্চউপন্যাসদুটি লেখেন।[১৩৩এর মধ্যে প্রথম উপন্যাসটি মিলনান্তক  দ্বিতীয়টি বিয়োগান্তক।[১৩৩]রবীন্দ্রনাথের শেষ উপন্যাস চার অধ্যায় সমসাময়িক বিপ্লবী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একটি বিয়োগান্তক প্রেমের উপন্যাস।[১৩৩]
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সত্যজিৎ রায়ের ঘরে বাইরে)[১৪৪ ঋতুপর্ণ ঘোষের চোখের বালি।
প্রবন্ধ  পত্রসাহিত্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা  ইংরেজি ভাষায় অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। [৩১এইসব প্রবন্ধে তিনি সমাজরাষ্ট্রনীতিধর্মসাহিত্যতত্ত্বইতিহাসভাষাতত্ত্বছন্দসংগীত ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেন।[৩১রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তামূলক প্রবন্ধগুলি সমাজ (১৯০৮সংকলনে সংকলিত হয়েছে।[৩১রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময়ে লেখা রাজনীতি-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি সংকলিত হয়েছে কালান্তর (১৯৩৭সংকলনে।[৩১রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা  আধ্যাত্মিক অভিভাষণগুলি সংকলিত হয়েছে ধর্ম (১৯০৯ শান্তিনিকেতন (১৯০৯-১৬অভিভাষণমালায়।[৩১রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি স্থান পেয়েছে ভারতবর্ষ (১৯০৬),ইতিহাস (১৯৫৫ইত্যাদি গ্রন্থে।[৩১সাহিত্য (১৯০৭), সাহিত্যের পথে (১৯৩৬ সাহিত্যের স্বরূপ (১৯৪৩গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যতত্ত্ব আলোচনা করেছেন।[৩১রবীন্দ্রনাথ ধ্রুপদি ভারতীয় সাহিত্য  আধুনিক সাহিত্যের সমালোচনা করেছেন যথাক্রমে প্রাচীন সাহিত্য (১৯০৭ আধুনিক সাহিত্য (১৯০৭গ্রন্থদুটিতে।[৩১লোকসাহিত্য (১৯০৭প্রবন্ধমালায় তিনি আলোচনা করেছেন বাংলা লোকসাহিত্যের প্রকৃতি।[৩১ভাষাতত্ত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা লিপিবদ্ধ রয়েছেশব্দতত্ত্ব (১৯০৯), বাংলা ভাষা পরিচয় (১৯৩৮ইত্যাদি গ্রন্থে।[৩১ছন্দ  সংগীত নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন যথাক্রমে ছন্দ (১৯৩৬ সংগীতচিন্তা (১৯৬৬গ্রন্থে।[৩১বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা-সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তার কথা প্রকাশ করেছেন শিক্ষা (১৯০৮প্রবন্ধমালায়।[৩১ন্যাশনালিজম (ইংরেজি: Nationalism, ১৯১৭গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ উগ্র জাতীয়তাবাদের বিশ্লেষণ করে তার বিরোধিতা করেছেন।[৩১অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দর্শন বিষয়ে যে বিখ্যাত বক্তৃতাগুলি দিয়েছিলেন সেগুলি রিলিজিয়ন অফ ম্যান (ইংরেজি: Religion of Man, ১৯৩০বাংলা অনুবাদ মানুষের ধর্ম১৯৩৩নামে সংকলিত হয়।[৩১দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা জন্মদিনের অভিভাষণ সভ্যতার সংকট (১৯৪১তাঁর সর্বশেষ প্রবন্ধগ্রন্থ।[৩১]জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপরিচয় (১৯৩৭নামে একটি তথ্যমূলক প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছিলেন।[৩১জীবনস্মৃতি (১৯১২), ছেলেবেলা (১৯৪০ আত্মপরিচয় (১৯৪৩তাঁর আত্মকথামূলক গ্রন্থ।[৩১]
রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক পত্রসাহিত্য আজ পর্যন্ত উনিশটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।[১২এছাড়া ছিন্নপত্রও ছিন্নপত্রাবলী (ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে লেখা), ভানুসিংহের পত্রাবলী (রানু অধিকারীকে (মুখোপাধ্যায়লেখা পথে  পথের প্রান্তে (নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লেখাবই তিনটি রবীন্দ্রনাথের তিনটি উল্লেখযোগ্য পত্রসংকলন।[১২]
নাট্যসাহিত্য


বাল্মীকি-প্রতিভা নাটকের দৃশ্যকলকাতার একটি দুর্গাপূজা মণ্ডপের দেওয়ালচিত্রে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে ছিলেন নাট্যকার  নাট্যাভিনেতা।[১৪৫]জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক নাট্যমঞ্চে মাত্র ষোলো বছর বয়সে অগ্রজজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত হঠাৎ নবাব নাটকে (মলিয়ের লা বুর্জোয়া জাঁতিরোম অবলম্বনে রচিত) [১৪৬ পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরই অলীকবাবুনাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।[১৪৫১৮৮১ সালে তাঁর প্রথম গীতিনাট্য বাল্মীকি-প্রতিভা মঞ্চস্থ হয়।[১৪৫][১৪৭এই নাটকে তিনি ঋষি বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।[১৪৫][১৪৭১৮৮২ সালে রবীন্দ্রনাথ রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে কালমৃগয়া নামে আরও একটি গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন।[১৪৫][১৪৭এই নাটক মঞ্চায়নের সময় তিনি অন্ধমুনির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।[১৪৫][১৪৭]
গীতিনাট্য রচনার পর রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি কাব্যনাট্য রচনা করেন।[১৪৫][১৪৭শেকসপিয়রীয়পঞ্চাঙ্ক রীতিতে রচিত তাঁর রাজা  রাণী (১৮৮৯)[১৪৮ বিসর্জন (১৮৯০)[১৪৯বহুবার সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয় এবং তিনি নিজে এই নাটকগুলিতে অভিনয়ও করেন।[১৪৫১৮৮৯ সালে রাজা  রাণী নাটকে বিক্রমদেবের ভূমিকায় অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ।[১৪৫বিসর্জননাটকটি দুটি ভিন্ন সময়ে মঞ্চায়িত করেছিলেন তিনি।[১৪৫১৮৯০ সালের মঞ্চায়নের সময় যুবক রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ রঘুপতির ভূমিকায় এবং ১৯২৩ সালের মঞ্চায়নের সময় বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ যুবক জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।[১৪৫কাব্যনাট্য পর্বে রবীন্দ্রনাথের আরও দুটি উল্লেখযোগ্য নাটক হল চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২)[১৫০ মালিনী (১৮৯৬)[১৪৫][১৫১]
কাব্যনাট্যের পর রবীন্দ্রনাথ প্রহসন রচনায় মনোনিবেশ করেন।[১৪৫এই পর্বে প্রকাশিত হয়গোড়ায় গলদ (১৮৯২), বৈকুণ্ঠের খাতা (১৮৯৭), হাস্যকৌতুক (১৯০৭ ব্যঙ্গকৌতুক(১৯০৭)[১৪৫বৈকুণ্ঠের খাতা নাটকে রবীন্দ্রনাথ কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।[১৪৫]১৯২৬ সালে তিনি প্রজাপতির নির্বন্ধ উপন্যাসটিকেও চিরকুমার সভা নামে একটি প্রহসনমূলক নাটকের রূপ দেন।[১৪৫][১৫২]


তাসের দেশ নাটকের একটি আধুনিক উপস্থাপনা
১৯০৮ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ রূপক-সাংকেতিক তত্ত্বধর্মী নাট্যরচনা শুরু করেন।[১৪৫]ইতিপূর্বে প্রকৃতির প্রতিশোধ(১৮৮৪নাটকে তিনি কিছুটা রূপক-সাংকেতিক আঙ্গিক ব্যবহার করেছিলেন।[১৪৫]কিন্তু ১৯০৮ সালের পর থেকে একের পর এক নাটক তিনি এই আঙ্গিকে লিখতে শুরু করেন।[১৪৫এই নাটকগুলি হলশারদোৎসব (১৯০৮), রাজা (১৯১০), ডাকঘর (১৯১২), অচলায়তন (১৯১২), ফাল্গুনী(১৯১৬), মুক্তধারা (১৯২২), রক্তকরবী (১৯২৬), তাসের দেশ (১৯৩৩), কালের যাত্রা (১৯৩২ইত্যাদি।[১৪৫এই সময় রবীন্দ্রনাথ প্রধানত শান্তিনিকেতনে মঞ্চ তৈরি করে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অভিনয়ের দল গড়ে মঞ্চস্থ করতেন।[১৪৫কখনও কখনও কলকাতায় গিয়েও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করতেন তিনি।[১৪৫এই সব নাটকেও একাধিক চরিত্রে অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ।[১৪৫তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য১৯১১ সালে শারদোৎসব নাটকে সন্ন্যাসী এবং রাজানাটকে রাজা  ঠাকুরদাদার যুগ্ম ভূমিকায় অভিনয়১৯১৪ সালে অচলায়তন নাটকে অদীনপুণ্যের ভূমিকায় অভিনয়১৯১৫ সালে ফাল্গুনী নাটকে অন্ধ বাউলের ভূমিকায় অভিনয়১৯১৭ সালেডাকঘর নাটকে ঠাকুরদাপ্রহরী  বাউলের ভূমিকায় অভিনয়।[১৪৫নাট্যরচনার পাশাপাশি এই পর্বে ছাত্রছাত্রীদের অভিনয়ের প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ পুরোন নাটকগুলি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ করে নতুন নামে প্রকাশ করেন।[১৪৫শারদোৎসব নাটকটি হয় ঋণশোধ (১৯২১), রাজা হয় অরূপরতন(১৯২০), অচলায়তন হয় গুরু (১৯১৮), গোড়ায় গলদ হয় শেষরক্ষা (১৯২৮), রাজা  রাণী হয়তপতী (১৯২৯এবং প্রায়শ্চিত্ত হয় পরিত্রাণ (১৯২৯)[১৪৫]
১৯২৬ সালে নটীর পূজা নাটকে অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে নাচ  গানের প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।[১৪৫এই ধারাটিই তাঁর জীবনের শেষ পর্বে “নৃত্যনাট্য” নামে পূর্ণ বিকাশ লাভ করে।[১৪৫নটীর পূজা নৃত্যনাট্যের পর রবীন্দ্রনাথ একে একে রচনা করেন শাপমোচন (১৯৩১),তাসের দেশ (১৯৩৩), নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা (১৯৩৬), নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা (১৯৩৮ শ্যামা(১৯৩৯)[১৪৫এগুলিও শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরাই প্রথম মঞ্চস্থ করেছিলেন।[১৪৫]
সংগীত  নৃত্যকলা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্ঠে তবু মনে রেখো


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্ঠে তবু মনে রেখো গান[১৫৩]
________________________________________
এই ফাইলটি শুনতে অসুবিধামিডিয়া সাহায্য দেখুন।
মূল নিবন্ধরবীন্দ্রসংগীত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৫টিগান রচনা করেছিলেন।[১০]ধ্রুপদি ভারতীয় সংগীতবাংলা লোকসংগীত  ইউরোপীয় সংগীতের ধারা তিনটিকে আত্মস্থ করে তিনি একটি স্বকীয় সুরশৈলীর জন্ম দেন।[১৫৪]রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু কবিতাকে গানে রূপান্তরিত করেছিলেন।[১৫৫রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ সুকুমার সেন রবীন্দ্রসংগীত রচনার ইতিহাসে চারটি পর্ব নির্দেশ করেছেন।[১৫৬প্রথম পর্বে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্ট গীতের অনুসরণে গান রচনা শুরু করেছিলেন।[১৫৬দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৮৮৪-১৯০০পল্লীগীতি  কীর্তনের অনুসরণে রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব সুরে গান রচনা শুরু করেন।[১৫৬এই পর্বের রবীন্দ্রসংগীতে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট সংগীতস্রষ্টা মধুকানরামনিধি গুপ্তশ্রীধর কথক প্রমুখের প্রভাবও সুস্পষ্ট।[১৫৬এই সময় থেকেই তিনি স্বরচিত কবিতায় সুর দিয়ে গান রচনাও শুরু করেছিলেন।[১৫৬১৯০০ সালে শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু করার পর থেকে রবীন্দ্রসংগীত রচনার তৃতীয় পর্বের সূচনা ঘটে।[১৫৬এই সময় রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের সুর  ভাব তাঁর নিজের গানের অঙ্গীভূত করেন।[১৫৬প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথের গান রচনার চতুর্থ পর্বের সূচনা হয়।[১৫৬কবির এই সময়কার গানের বৈশিষ্ট্য ছিল নতুন নতুন ঠাটের প্রয়োগ এবং বিচিত্র  দুরূহ সুরসৃষ্টি।[১৫৬তাঁর রচিত সকল গান সংকলিত হয়েছে গীতবিতান গ্রন্থে।[৩৬এই গ্রন্থের "পূজা", "প্রেম", "প্রকৃতি", "স্বদেশ", "আনুষ্ঠানিক "বিচিত্রপর্যায়ে মোট দেড় হাজার গান সংকলিত হয়।[৩৬পরে গীতিনাট্যনৃত্যনাট্যনাটককাব্যগ্রন্থ  অন্যান্য সংকলন গ্রন্থ থেকে বহু গান এই বইতে সংকলিত হয়েছিল।[৩৬ইউরোপীয় অপেরার আদর্শে বাল্মীকি-প্রতিভাকালমৃগয়া গীতিনাট্য এবং চিত্রাঙ্গদাচণ্ডালিকা শ্যামা সম্পূর্ণ গানের আকারে লেখা।[৩৬]
রবীন্দ্রনাথের সময় বাংলার শিক্ষিত পরিবারে নৃত্যের চর্চা নিষিদ্ধ ছিল।[১২২কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর পাঠক্রমে সংগীত  চিত্রকলার সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যকেও অন্তর্ভুক্ত করেন।[১২২ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোকনৃত্য  ধ্রুপদি নৃত্যশৈলীগুলির সংমিশ্রণে তিনি এক নতুন শৈলীর প্রবর্তন করেন।[১২২এই শৈলীটি "রবীন্দ্রনৃত্যনামে পরিচিত।[১২২রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য  নৃত্যনাট্যগুলিতে গানের পাশাপাশি নাচও অপরিহার্য।[১২২বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী উদয় শংকর যে আধুনিক ভারতীয় নৃত্যধারার প্রবর্তন করেছিলেনতার পিছনেও রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা ছিল।[১২২]
চিত্রকলা


"ড্যান্সিং গার্ল", রবীন্দ্রনাথ অঙ্কিত একটি তারিখবিহীন চিত্র
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন প্রায় সত্তর বছর বয়সে।[১৩চিত্রাঙ্কনে কোনো প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না।[১৩]প্রথমদিকে তিনি লেখার হিজিবিজি কাটাকুটিগুলিকে একটি চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করতেন।[১৩এই প্রচেষ্টা থেকেই তাঁর ছবি আঁকার সূত্রপাত ঘটে।[১৩১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ কালপরিধিতে অঙ্কিত তাঁর স্কেচ  ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের ওপরযার ১৫৭৪টি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে।[১৫৭দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে।[১৫৮এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।[১৩ছবিতে রং  রেখার সাহায্যে রবীন্দ্রনাথ সংকেতের ব্যবহার করতেন।[১৩]রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য চিত্রকলার পুনরুত্থানে আগ্রহী হলেওতাঁর নিজের ছবিতে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে। মূলত কালি-কলমে আঁকা স্কেচজলরং  দেশজ রঙের ব্যবহার করে তিনি ছবি আঁকতেন।[১৩তাঁর ছবিতে দেখা যায় মানুষের মুখের স্কেচঅনির্ণেয় প্রাণীর আদলনিসর্গদৃশ্যফুলপাখি ইত্যাদি। তিনি নিজের প্রতিকৃতিও এঁকেছেন।[১৩]নন্দনতাত্ত্বিক  বর্ণ পরিকল্পনার দিক থেকে তাঁর চিত্রকলা বেশ অদ্ভুত ধরণেরই বলে মনে হয়।[১৩]তবে তিনি একাধিক অঙ্কনশৈলী রপ্ত করেছিলেন।[১৩তন্মধ্যেকয়েকটি শৈলী হলনিউ আয়ারল্যান্ডের হস্তশিল্পকানাডার (ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশপশ্চিম উপকূলের "হাইদাখোদাইশিল্প  ম্যাক্স পেকস্টাইনের কাঠখোদাই শিল্প।[১৪০]
রাজনৈতিক মতাদর্শ  শিক্ষাচিন্তা
মূল নিবন্ধরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক মতাদর্শ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক দর্শন অত্যন্ত জটিল। তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা  ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করতেন।[১৫৯][১৬০][১৬১১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক  সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়।[১৬২হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার তথ্যপ্রমাণ এবং পরবর্তীকালে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়রবীন্দ্রনাথ গদর ষড়যন্ত্রের কথা শুধু জানতেনই নাবরং উক্ত ষড়যন্ত্রে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি  প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন।[১৬৩আবার ১৯২৫ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে "চরকা-সংস্কৃতিবলে বিদ্রুপ করে রবীন্দ্রনাথ কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেন।[১৬৪ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাঁর চোখে ছিল "আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলির রাজনৈতিক উপসর্গ" তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বৃহত্তর জনসাধারণের স্বনির্ভরতা  বৌদ্ধিক উন্নতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। ভারতবাসীকে অন্ধ বিপ্লবের পন্থা ত্যাগ করে দৃঢ়  প্রগতিশীল শিক্ষার পন্থাটিকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান রবীন্দ্রনাথ।[১৬৫][১৬৬]


শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের আতিথেয়তায়মহাত্মা গান্ধী  তাঁর পত্নী কস্তুরবা গান্ধী১৯৪০।
রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের মতাদর্শ অনেককেই বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯১৬ সালের শেষ দিকে সানফ্রান্সিসকোয় একটি হোটেলে অবস্থানকালে একদল চরমপন্থী বিপ্লবী রবীন্দ্রনাথকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ উপস্থিত হওয়ায় তাঁদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল।[১৬৭ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের গান  কবিতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯১৯ সালেজালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড বর্জন করেন।[১৬৮নাইটহুড প্রত্যাখ্যান-পত্রে লর্ড চেমসফোর্ডকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।রবীন্দ্রনাথের "চিত্ত যেথা ভয়শূন্য "একলা চলো রেরাজনৈতিক রচনা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। "একলা চলো রেগানটি গান্ধীজির বিশেষ প্রিয় ছিল।[১৬৯যদিও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। হিন্দু নিম্নবর্ণীয় জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজি  আম্বেডকরের যে মতবিরোধের সূত্রপাত হয়তা নিরসনেও রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে গান্ধীজিও তাঁর অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।[১৭০][১৭১]
রবীন্দ্রনাথ তাঁর "তোতা-কাহিনীগল্পে বিদ্যালয়ের মুখস্ত-সর্বস্ব শিক্ষাকে প্রতি তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেনদেশের ছাত্রসমাজকে খাঁচাবদ্ধ পাখিটির মতো শুকনো বিদ্যা গিলিয়ে কিভাবে তাদের বৌদ্ধিক মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।[১৭২][১৭৩১৯১৭ সালের ১১ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা বারবারা ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা সম্পর্কে প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তাভাবনা শুরু করেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমকে দেশ  ভূগোলের গণ্ডীর বাইরে বের করে ভারত  বিশ্বকে একসূত্রে বেঁধে একটি বিশ্ব শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাও এই সময়েই গ্রহণ করেছিলেন কবি।[১৬৭১৯১৮ সালের ২২ অক্টোবর বিশ্বভারতীη[›] নামাঙ্কিত তাঁর এই বিদ্যালয়ের শিলান্যাস করা হয়েছিল। এরপর ১৯২২ সালের ২২ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়েছিল এই বিদ্যালয়ের।[১৭৪]বিশ্বভারতীতে কবি সনাতন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্রহ্মচর্য  গুরুপ্রথার পুনর্প্রবর্তন করেছিলেন। এই বিদ্যালয়ের জন্য অর্থসংগ্রহ করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন তিনি। নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে প্রাপ্ত সম্পূর্ণ অর্থ তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন এই বিদ্যালয়ের পরিচালন খাতে।[১৭৫]নিজেও শান্তিনিকেতনের অধ্যক্ষ  শিক্ষক হিসেবেও অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতেন তিনি। সকালে ছাত্রদের ক্লাস নিতেন এবং বিকেল  সন্ধ্যায় তাদের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করতেন।[১৭৬১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে তিনি একাধিকবার ইউরোপ  আমেরিকা ভ্রমণ করেন।[১৭৭]
প্রভাব


প্রাগের রবীন্দ্রমূর্তি
বিংশ শতাব্দীর বাঙালি সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ তথা দার্শনিক অমর্ত্য সেনরবীন্দ্রনাথকে এক "হিমালয়প্রতিম ব্যক্তিত্ব "গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক  বহুমাত্রিক সমসাময়িক দার্শনিকহিসেবে বর্ণনা করেছেন।[১৭৮বত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়। রবীন্দ্রনাথকে "ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিহিসেবেও বর্ণনা করা হয়ে থাকে।[১৭৯রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী "পঁচিশে বৈশাখ প্রয়াণবার্ষিকী "বাইশে শ্রাবণআজও বাঙালি সমাজে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। এই উপলক্ষ্যে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িশান্তিনিকেতন আশ্রম  শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে প্রচুর জনসমাগম হয়। শান্তিনিকেতনেরবিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত ধর্মীয়  ঋতুউৎসবগুলির মাধ্যমেও তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদনের রীতি অক্ষুন্ন আছে। এছাড়াও বিভিন্ন উৎসবে  অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া বা রবীন্দ্ররচনা পাঠের রেওয়াজও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এগুলি ছাড়াও কবির সম্মানে আরও কতকগুলি বিশেষ  অভিনব অনুষ্ঠান পালন করা হয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় রাজ্যের আরবানাতে আয়োজিত বার্ষিক "রবীন্দ্র উৎসব", কলকাতা-শান্তিনিকেতন তীর্থ-পদযাত্রা "রবীন্দ্র পথপরিক্রমাইত্যাদি।[১০৩][১৭৮][১৮০]


জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িবর্তমানে কবির নামাঙ্কিত রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষাপ্রাঙ্গন
জীবদ্দশাতেই ইউরোপউত্তর আমেরিকা  পূর্ব এশিয়ায় প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইংল্যান্ডে ডার্টিংটন হল স্কুল নামে একটি প্রগতিশীল সহশিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি।[১৮১অনেজ জাপানি সাহিত্যিককে তিনি প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[১৮২রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থাবলি অনূদিত হয় ইংরেজিওলন্দাজজার্মানস্প্যানিশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। চেক ভারততত্ত্ববিদ ভিনসেন্স লেনসি সহ একাধিক ইউরোপীয় ভাষায় তাঁর গ্রন্থ অনুবাদ করেন।[১৮৩ফরাসি নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আন্দ্রে জিদ্রাশিয়ান কবি আনা আখমাতোভা [১৮৪], প্রাক্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বুলেন্ত একেভিত[১৮৫], মার্কিন ঔপন্যাসিক জোনা গেইল সহ অনেকেই অনুপ্রেরণা লাভ করেন রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে। ১৯১৬-১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দেওয়া তাঁর ভাষণগুলি বিশেষ জনপ্রিয়তা  প্রশংসা পায়। তবে কয়েকটি বিতর্ককে কেন্দ্র করে ১৯২০-এর দশকের শেষদিকে জাপান  উত্তর আমেরিকায় তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। কালক্রমে বাংলার বাইরে রবীন্দ্রনাথ "প্রায় অস্তমিতহয়ে পড়েছিলেন।[১৮৬]
চিলিয়ান সাহিত্যিক পাবলো নেরুদা  গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালমেক্সিকান লেখক অক্টাভিও পাজ  স্প্যানিশ লেখক হোসে অরতেগা ওয়াই গ্যাসেৎথেনোবিয়া কামপ্রুবি আইমার হুয়ান রামোন হিমেনেথ প্রমুখ স্প্যানিশ-ভাষী সাহিত্যিকদেরও অনুবাদের সূত্রে অনুপ্রাণিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৪ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে হিমেনেথ-কামপ্রুবি দম্পতি রবীন্দ্রনাথের বাইশটি বই ইংরেজি থেকে স্প্যানিশে অনুবাদ করেছিলেন। দ্য ক্রেসেন্ট মুন (শিশু ভোলানাথসহ রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু রচনার বিস্তারিত পর্যালোচনা  স্প্যানিশ সংস্করণ প্রকাশও করেছিলেন তাঁরা। উল্লেখ্যএই সময়েই হিমেনেথ "নগ্ন কবিতা" (স্প্যানিশ: «poesia desnuda») নামে এক বিশেষ সাহিত্যশৈলীর উদ্ভাবন ঘটান।[১৮৭]
রবীন্দ্রনাথের মূল বাংলা কবিতা পড়েননি এমন বহু পাশ্চাত্য সাহিত্যিক  সাহিত্য সমালোচক রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব অস্বীকারও করেছিলেন। গ্রাহাম গ্রিন সন্দিগ্ধচিত্তে মন্তব্য করেছিলেন, "ইয়েটস সাহেব ছাড়া আর কেউই রবীন্দ্রনাথের লেখাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন না।"[১৮৬রবীন্দ্রনাথের সম্মানের কিছু পুরনো লাতিন আমেরিকান খণ্ডাংশ সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। নিকারাগুয়া ভ্রমণের সময় সালমান রুশদি এই জাতীয় কিছু উদাহরণ দেখে অবাক হন।[১৮৮]


উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে 

0 comments :

Post a Comment